সুপার সাইক্লোন আম্পানে সব হারিয়ে নিঃস্ব সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার শ্রিউলা ইউনিয়নের হাজরাখালী গ্রামের নূর ইসলামের বৃদ্ধা স্ত্রী মাহাফুজা খাতুন (৭০) এভাবেই চোখের পানি ফেলে চরম দুর্ভোগের কথা জানাচ্ছিলেন।
বৃদ্ধা ফাতেমা খাতুন আম্পানের পর থেকেই নদীগর্ভে বিলীন হওয়া বসত বাড়ির ঠিক পাশে নদীর বেড়িবাঁধের ওপর মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন।
হাজরাখালী গ্রামের নজরুল ইসলাম (৫৮) বলেন, ‘আমার মতো অসংখ্য মানুষ বসত ভিটা হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে। আশ্রয় নিয়েছি বাঁধের ওপরে। অনেকে কষ্ট সহ্য করতে না পেরে এলাকা ছেড়ে চলে গেছে। বাড়ি ঘরের কোনো চিহ্ন নেই। বসত ভিটার ওপর তৈরি হয়েছে নদী, বইছে জোয়ার-ভাটা। শীতকাল পড়েছে। শীতবস্ত্রের অভাব ও পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবে বেড়িবাঁধের ওপর আশ্রয় নেয়া শিশুগুলো দিন দিন অসুস্থ হয়ে পড়ছে। শীতবস্ত্রের অভাবে শিশুগুলো কাবু হয়ে পড়েছে।’
শুধু বৃদ্ধা ফাতেমা বা নজরুল ইসলাম নয়, হাজরাখালী বেড়িবাঁধের ওপর ছয় মাস ধরে আশ্রয় নেয়া ৭০টি পরিবারের মানুষ এভাবেই তাদের দুর্ভোগের করুণ চিত্র তুলে ধরেন। তারা অন্য কিছু চান না, তাদের দাবি টেকসই বেড়িবাঁধ।
সাতক্ষীরার আম্পান দুর্গত আশাশুনি উপজেলার প্রায় ২০ হাজার মানুষ এখনো নদীর জোয়ার ভাটার সাথে বসবাস করছে। আম্পান আঘাত হানার ছয় মাস অতিবাহিত হলেও বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধের একাধিক জায়গায় এখনো সংস্কার করা সম্ভব হয়নি। ফলে আশাশুনি উপজেলার শ্রিউলা ও প্রতাপনগর ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় বেড়িবাঁধের ওপর টং ঘর বেধে এবং সাইক্লোন শেল্টারে শত শত পরিবার মানবেতর জীবনযাপন করছে।
দুর্গত এলাকায় দেখা দিয়েছে খাদ্য ও চিকিৎসা সংকট, শীতবস্ত্র নেই। এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা বিধ্বস্ত। সব মিলিয়ে অবর্ণনীয় দুর্ভোগের মধ্যে তারা দিনাতিপাত করছেন। বসত ভিটায় কবে ফিরে যেতে পারবেন তাও কেউ বলতে পারেন না। অনিশ্চিত এক জীবন কাটছে তাদের।
চলতি বছরের ২০ মে সাতক্ষীরা উপকূলবর্তী অঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে যায় সুপার সাইক্লোন আম্পান। শক্তিশালী আম্পানের তাণ্ডবে বিধ্বস্ত হয় সাতক্ষীরার বিস্তীর্ণ জনপদ। সবচেয়ে ক্ষতি হয় জেলার আশাশুনি ও শ্যামনগর উপকূলবর্তী অঞ্চল। ওই দুটি উপজেলার ২৩টি পয়েন্টে বেড়িবাঁধ ধ্বসে গ্রামের পর গ্রাম ভেসে যায়। কয়েক হাজার চিংড়ি ঘের ভেসে কোটি কোটি টাকার মাছ নষ্ট হয়। পানিবন্দি হয়ে পড়ে দেড় লক্ষাধিক মানুষ। স্থানীয়দের বিরামহীন প্রচেষ্টায় এ পর্যন্ত ১৮টি পয়েন্টে সংস্কার করা সম্ভব হলেও আশাশুনি উপজেলার হাজরাখালী, কুড়িকাউনিয়া, চাকলা, হরিসপুরসহ আশপাশের পাঁচটি জায়গা এখনো মেরামত করা সম্ভব হয়নি। ফলে শ্রিউলা ও প্রতাপনগর ইউনিয়নের প্রায় ২০টি গ্রামের ওপর দিয়ে এখনো নদীর জোয়ার-ভাটা বইছে।
সেনাবাহিনী ও পানি উন্নয়ন বোর্ড আম্পান পরবর্তী সময়ে কয়েক দফা চেষ্টা করেও নদীর প্রবল স্রোতের কারণে হাজরাখালী, কুড়িকাউনিয়া, চাকলাসহ ধসে পড়া বেড়িবাঁধ সংস্কার করতে না পেরে চলে যায় পাঁচ মাস আগেই। আর এসব জায়গা দিয়ে নদীর জোয়ার-ভাটা ওঠা নামা করছে।
আশাশুনি উপজেলার শ্রিউলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবু হেনা সাকিল বলেন, ‘আম্পান ছয় মাস অতিবাহিত হয়েছে। হাজরাখালী পয়েন্টে এখনো বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি। ফলে আমার ইউনিয়নের পাঁচটি গ্রামের ওপর দিয়ে জোয়ার-ভাটা খেলছে। সহস্রাধিক মানুষ গত ছয় মাস ধরে বেড়িবাঁধ ও স্থানীয় সাইক্লোন শেল্টারে অবস্থান করছে। তারা বাড়ি-ঘরে ফিরতে পারেনি। শুনেছি সেনাবাহিনী হাজরাখালী বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য আসবে। কিন্তু এখনো পৌঁছায়নি।’
স্থানীয় প্রশাসন বলছে, নদীর খরস্রোতের কারণে আশাশুনির কয়েকটি স্থানে ধসেপড়া বেড়িবাঁধ গত ছয় মাসেও সংস্কার করা সম্ভব হয়নি। তবে সরকার চলতি শীত মৌসুমে সাতক্ষীরা উপকূলীয় আশাশুনি ও শ্যামনগর অঞ্চলে স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য তোড়জোর শুরু করেছে। শিগগিরই বাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু করা হবে।
প্রতাপনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাকির হোসেন বলেন, ‘আমার ইউনিয়নের ১৭টি গ্রামের ওপর দিয়ে এখনো নদীর জোয়ার-ভাটা বইছে। কুড়িকাউনিয়া, চাকলা, হরিসখালী বেড়িবাঁধ গত ছয় মাসেও সংস্কার করা সম্ভব হয়নি। ডিসেম্বরের মধ্যে যদি ধসেপড়া এসব বাঁধ সংস্কার করা না যায় তাহলে আর বাধা সম্ভব হবে না।’
সাতক্ষীরা পানি উন্নয় বোর্ড-২ নির্বাহী প্রকৌশলী সুধাংশু কুমার সরকার বলেন, ‘নদীতে প্রবল স্রোতের কারণে আম্পানের পর চেষ্টা করেও ধসেপড়া বেড়িবাঁধ সংস্কার করা সম্ভব হয়নি। এখন শুকনা মৌসুম শুরু হয়েছে। ডিসেম্বর থেকে আমরা বেড়িবাঁধের সংস্কার কাজ শুরু করার চেষ্টা করছি। আশা করছি যে সকল জায়গা এখনো মেরামত বা সংস্কার করা সম্ভব হয়নি তা সংস্কার করা সম্ভব হবে।’